স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন ভারতবর্ষের একজন একজন কিংবদন্তী যার অবদান ভারতবর্ষের প্রতিটি মানুষ এখনো শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।স্বামী বিবেকানন্দ এমন একজন মানুষ ছিলেন যার গুণকীর্তন বলে শেষ করা যাবেনা। একাধারে তিনি ছিলেন দার্শনিক, লেখক,সংগীতজ্ঞ এবং সন্ন্যাসী।স্বামী বিবেকানন্দ যে শুধু নিজের ধ্যান-জ্ঞান নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন তা কিন্তু নয়। তিনি ছিলেন অনেক দয়াশীল একজন মানুষ।
হিন্দু ধর্মের প্রতি তার অগাধ ভালবাসা ছিল। হিন্দু ধর্মের প্রচার ও প্রসার নিয়ে একনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন স্বামী বিবেকানন্দ।হিন্দু ধর্মের প্রতি তার এই শদ্ধভক্তি তাকে রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন তৈরিতে অনুপ্রাণিত করে।
স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম উত্তর কলকাতার বিখ্যাত দত্ত পরিবারে।স্বামী বিবেকানন্দের জন্মের সালটি ছিল ১৮৬৩। অর্থাৎ ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি ধরণির বুকে আগমন ঘটে ভারতবর্ষের এই বিখ্যাত দার্শনিকের।স্বামী বিবেকানন্দের বাবার নাম ছিল বিশ্বনাথ দত্ত এবং মাতার নাম ছিল বনেশ্বরী দেবী।

স্বামী বিবেকানন্দের সংক্ষিপ্ত বায়োডাটা
নাম | স্বামী বিবেকানন্দ |
ছোটবেলার ডাকনাম | বীরেশ্বর বিলে |
উপাধি | স্বামীজি |
জন্ম | ১২ জানুয়ারি ১৮৬৩ (কোলকাতা) |
পিতা | বিশ্বনাথ দত্ত |
মাতা | ভুবনেশ্বরী দেবী |
দাম্পত্য জীবন সঙ্গী | অবিবাহিত |
আধ্যাত্মিক গুরু | শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস |
শিষ্য(সমূহ) | আলাসিঙ্গা পেরুমল, অভয়ানন্দ, ভগিনী নিবেদিতা, সদানন্দ |
প্রভাবিত হয়েছেন | সুভাষচন্দ্র বসু, অরবিন্দ ঘোষ, মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জহরলাল নেহেরু, নিকোলা টেসলা, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, অ্যানি বেসান্ত, নরেন্দ্র মোদি |
দর্শন | অদ্বৈত বেদান্ত, রাজযোগ |
উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় সাহিত্যকর্ম সমগ্র | রাজযোগ, কর্মযোগ, ভক্তিযোগ, জ্ঞানযোগ, মদীয় আচার্যদেব, ভারতে বিবেকানন্দ |
ধর্ম | হিন্দু |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
মৃত্যু | ৪ জুলাই ১৯০২ |
মৃত্যুস্থান | বেলুড় মঠ, হাওড়া |
প্রতিষ্ঠাতা | রামকৃষ্ণ মিশন রামকৃষ্ণ মঠ |
আরো পড়ুনঃ
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের জীবন বৃত্তান্ত
জগদীশ চন্দ্র বসুর জীবন বৃত্তান্ত
হুমায়ুন আজাদের জীবন বৃত্তান্ত
স্বামী বিবেকানন্দের প্রাথমিক জীবন
বাল্যকাল থেকেই ধ্যানের প্রতি অসম্ভব টান ছিল স্বামী বিবেকানন্দের।বিভিন্ন দেবদেবীর সামনে বসে আরাধোনা করতেন তিনি।সাধুসন্ন্যাসীদের প্রতিও স্বামী বিবেকানন্দের আগ্রহ ছিল বলার বাইরে।বাল্যকাল থেকেই স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন ভীষণ রকমের চঞ্চল।তার স্মৃতি শক্তি এতই প্রবল ছিল যে তিনি একবার যা দেখতেন তা আর কখনই ভুলতেন না।
তার আম তার দুরন্তপনার কাছে হেরে যেতেন বার বার।ধ্যান-জ্ঞান,তেজস্বিতা, সাহস ও খেলাধুলাতে এক দুরন্ত কিশরের নাম স্বামী বিবেকানন্দ।এই দুরন্ত এই কিশোরটি মানুষের বিপদ-আপদে এগিয়ে যেতেও পিছপা হননি কখনই।
স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা জীবন
এক সময়ের দুরন্ত কিশোর সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বড় হয়ে যান এবং শিক্ষার মাধ্যমে নিজেকে আরো আলোকিত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নিজ হাতে গড়া ইনস্টিটিউশন মেট্রোপলিটনে ভর্তি হন। ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এখানেই লেখাপড়া করেন। কিন্তু পরবর্তীতে ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দের পরিবার আবার কলকাতায় ফিরে যান অর্থাৎ ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দের পরিবার রায়পুরে স্থানান্তরিত হয়েছিল। ১৮৭৯ সালে স্বামী বিবেকানন্দ প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতজ্ঞতার সাথে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
বই পড়ার প্রতি প্রচণ্ড রকমের আগ্রহ ছিল স্বামী বিবেকানন্দের। জ্ঞানের সকল শাখাতেই সমান আধিপত্য ছিল তার। ধর্ম,দর্শন, সমাজবিজ্ঞান,ইতিহাস, সাহিত্য ও শিল্পকলায় তার আগ্রহ ছিল অসামান্য। স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাশ করেন মেট্রোপলিটন স্কুল থেকে । এরপর তিনি জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশনে পাশ্চাত্য যুক্তিবিদ্যা,পাশ্চাত্য দর্শন ও ইউরোপীয় ইতিহাস বিষয়ে অধ্যায়ন করেন এবং ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে এফ পাশ করেন। স্বামী বিবেকানন্দ কৃতজ্ঞতার সাথে ১৮৮৪ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
শ্রী রামকৃষ্ণের শিষ্যত্ব গ্রহণ
বাল্যকাল থেকেই ধর্মের প্রতি অসম্ভব টান ছিল স্বামী বিবেকানন্দের। ছোটবেলা থেকেই ঈশ্বর ও তার সৃষ্টি নিয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে থাকতেন স্বামী বিবেকানন্দ। একসময় তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কিনা এটা জানার জন্য অনেক ঋষি ও সাধুদের কাছে যেতে থাকেন কিন্তু কারো কাছে ভাল ভাল উত্তর না পেয়ে তিনি সরাসরি রামকৃষ্ণের কাছ গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন যে আপনি কি আপনি কি ঈশ্বরকে দেখেছেন?জবাবে রামকৃষ্ণ বলেছিলেন হ্যা আমি তোমার চেয়ে ঈশ্বরকে স্পষ্ট দেখেছি।
এই কথা শুনার পর স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।রামকৃষ্ণ স্বামী বিবেকানন্দকে বলেছিলেন মাবনসেবা হল সবচেয়ে বড় ধর্ম । এখান থেকে মাবনসেবার শিক্ষা লাভ করে স্বামী বিবেকানন্দ মানবসেবায় নিজেকে উজাড় করে দেন। ১৮৮৬ সালে শ্রী রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর স্বামী বিবেকানন্দসহ শ্রী রামকৃষ্ণের পনেরো জন শিষ্য উত্তর কলকাতার বরানগ নামক স্থানে বসবাস করতে থাকেন এবং সেখানে রামকৃষ্ণ মঠ গড়ে তোলেন।
পরিব্রাজক হিসেবে বিবেকানন্দ
স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৮৮ সালে রামকৃষ্ণ মঠ ত্যাগ করে পুরো ভারতবর্ষ ভ্রমনের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরেন।পুরো পাঁচ বছর ধরে ভারতের সর্বত্র ঘুরে বেড়ান স্বামী বিবেকানন্দ।তার এই পাঁচ বছরের ভ্রমণে তিনি দর্শন করেছেন বিভিন্ন শিক্ষাকেন্দ্র, পরিচিত হয়েছেন বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায় ও সমাজব্যবস্থার সঙ্গে।
পাঁচ বছরের এই ভ্রমণে তিনি সমানভাবে মিশেছেন পণ্ডিত, দেওয়ান, রাজা, এবং হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিস্টানদের সাথে।এছাড়াও তিনি গরীব দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে নিয়েছেন দেশকে উন্নত করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।
আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে স্বামী বিবেকানন্দের ধর্ম বকৃতা
বক্তা হিসেবে স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন তুমুল জনপ্রিয় একজন ব্যাক্তিত্ব। ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে শিকাগো আর্ট ইনস্টিটিউটে স্বামী বিবেকানন্দের ভাষণে স্তম্ভিত হয়েছিল আমেরিকার সর্বস্তরের মানুষ। ১৮৯৩ সাল থেকে টানা দুই বছর শিকাগো, ডেট্রয়েট, বোস্টন এবং নিউইয়র্কে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন স্বামী বিবেকানন্দ। তার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক বিদেশী তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন।
স্বামী বিবেকানন্দের জনপ্রিয় উক্তি
“ওঠো , জাগো এবং লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত থেমো না।”
“ইচ্ছা শক্তিই জগৎ কে পরিচালনা করে থাকে।”
“কোনো বড় কাজই কঠোর পরিশ্রম ও কষ্ট স্বীকার ছাড়া হয় নি।”
“সারাদিন চলার পথে যদি কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হও, তাহলে বুঝবে তুমি ভুল পথে চলেছ।”
“এমন কাজ করে চলো যে তুমি হাসতে হাসতে মরবে আর জগৎ তোমার জন্য কাঁদবে।”
“আমি বিশ্বাস করি যে, কেউ কিছু পাওয়ার উপযুক্ত হলে জগতের কোনো শক্তিই তাকে বঞ্চিত করতে পারে না।”
“যখন আমাদের মধ্যে অহংকার থাকে না, তখনই আমরা সবথেকে ভালো কাজ করতে পারি, অপরকে আমাদের ভাবে সবচেয়ে বেশি অভিভূত করতে পারি।”
“মনের মতো কাজ পেলে অতি মূর্খও করতে পারে। যে সকল কাজকেই মনের মতো করে নিতে পারে, সেই বুদ্ধিমান। কোনো কাজই ছোট নয়।”
“কাজ করো নির্ভীকভাবে। এগিয়ে চলো সত্য আর ভালোবাসা নিয়ে।
“যা পারো নিজে করে যাও, কারও ওপর আশা বা ভরসা কোনোটাই কোরো না।”
“সাহসী লোকেরাই বড় বড় কাজ করতে পারে।”
স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যু
স্বামী বিবেকানন্দ মানেই একজন সৎ,কর্মনিষ্ঠ ও পরিশ্রমী একজন মানুষ। একজন সন্যাসী ও দেশ প্রেমিক হিসেবে তিনি অধিক পরিচিত ছিলেন। দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা এই সন্যাসী ১৯০২ সালের ৪ জুলাই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে পরপারে পাড়ি জমান।